Alekh

বাঙালি মাত্রেই ভ্রমণের নেশায় বুঁদ। সর্বদা আমাদের পায়ের তলায় সর্ষে। কথাগুলো বোধহয় খুব একটা আতিশয্য নয়। এক সময় বাঙালি তীর্থযাত্রায় যেতো, পশ্চিমে হাওয়াবদল করতে যেত। লোটাকম্বল নিয়ে চেঞ্জে যাওয়ার দিন গেছে, এখন গ্লোবাল বাঙালীর সম্বল গুগল ম্যাপ, ব্যাকপ্যাক আর ভ্রমণ ব্লগ। তবে ভ্রমণের তীব্র ইচ্ছায় ছেদ পড়েনি কখনো। বিশ্বায়ন এবং উদারনীতি ভ্রমণেও পরিবর্তন এনেছে। হাতে গোনা কিছু পরিচিত ভ্রমণের স্থানে বারবার ফিরে যাওয়ার বদলে এসেছে অচেনার সন্ধান, অফবিটের খোঁজ। এই নতুন চাহিদা মোটামুটি বিংশ শতাব্দীর গোড়া থেকে আস্তে আস্তে বদলে দিয়েছে ভ্রমণ মানচিত্র। একসময় উত্তরবঙ্গের পাহাড় বলতে যেমন বোঝাত শুধু দার্জিলিং, কার্শিয়াং বা কালিম্পঙ; ধীরে ধীরে সে ধারণা ভেঙে উঠে এসেছে কত না অজানা পাহাড়ী গ্রামের নাম। যেখানে হয়ত এক পাহাড়ী ঝোরার পাশে, প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্যে কোনো এক গোর্খা যুবার ছোট্ট একটি বাড়িতে আপনি অতিথি হয়ে কাটিয়ে যেতে পারেন কয়েকটা দিন। এই ব্যবস্থার পোশাকি নাম ‘হোমস্টে’। ঔপনিবেশিক শৈলশহরের আভিজাত্যের বাইরে এও এক অনন্য অভিজ্ঞতা। ভ্রমণে এও এক বিনির্মাণ, এও এক উত্তর-ঔপনিবেশিকতা।

যাইহোক, তত্ত্বকথা ছেড়ে এবার নাহয় এমন এক সুন্দর হোমস্টের নির্ভেজাল গল্পে আসি। দিন সাতেক আগে আমাদের গন্তব্য ছিল কার্শিয়াংয়ের কাছে ‘সঞ্জীমা হোমস্টে’। বাগডোগরা বিমানবন্দরে হোমস্টের গাড়ি চলে এসেছিল। গন্তব্য কোনো অফবিট হোমস্টে হলে আগেভাগে তাদের কাছেই গাড়ি চেয়ে নেওয়া ভালো, পথ চিনতে কোনো অসুবিধা হয় না। তবে বাগডোগরা বিমানবন্দর যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ বিমানবন্দর হওয়া সত্ত্বেও বেশ ছোট। তিন চারটে ফ্লাইট একসাথে নেমে পড়লে পার্কিংয়েও জায়গা পাওয়া মুশকিল হয়। কাজেই হাঁটতে হল বেশ কিছুটা পথ। তবে গাড়ি যখন বেংডুবি পেরিয়ে চা বাগানের পাশ দিয়ে ছুটল তখন মনটাও ভালো হয়ে গেল। মাত্র ঘন্টা দেড়েকে পৌঁছে গেলাম আমাদের হোমস্টেতে। এখন, ইন্টারনেট ঘেঁটে এই ‘সঞ্জীমা হোমস্টে’ বেছে নেওয়ার কিছু বিশেষ কারণ ছিল। এই ট্রিপে সঙ্গে ছিলেন বেশ কয়েকজন বয়স্ক মানুষ। ঘন্টা দুয়েকের বেশি তাঁদের গাড়িতে বসে থাকা কষ্টের। হোমস্টেও হতে হবে মূল রাস্তার কাছেই, যাতে পাহাড়ি পথে ওঠানামা করতে না হয়। তবে ভ্রমণপিপাসু মন তাই বলে পাহাড়ের স্বাদ নেবে না? ‘সঞ্জীমা হোমস্টে’ দেখলাম সব শর্ত পূরণ করছে। শিলিগুড়ি থেকে খুব একটা দূরে নয়, এবং গাড়ি চলা রাস্তার একদম লাগোয়া হোমস্টে। সঞ্জীমা হোমস্টেতে পৌঁছে বুঝলাম, পাহাড়ের কোলে এ এক অসাধারণ আবিষ্কার।

কার্শিয়াং থেকে হিলকার্ট রোড ধরে একটু এগিয়েই বাঁদিকে একটা রাস্তা গোঁত খেয়ে অনেকটা নীচে নেমে গেছে। এই পুরো জায়গাটি ‘সিঙ্গেল’ চা বাগানের অংশ। তারই মাঝে ছবির মত দাঁড়িয়ে আছে ‘সঞ্জীমা হোমস্টে’। সঞ্জয় মানগারের এই বাড়িটির একতলায় ছিমছাম ডাইনিং, দোতলায় বসার এবং শোবার ঘর, আর তিনতলাটা ছাদ। দোতলায় তিনটি ঘর, বিছানা রয়েছে বসার ঘরেও। হেসেখেলে আট-দশ জন থেকে যাবে। পরিবার বা বন্ধুদের একটা বড় দল এলে দারুন জমে যাবে। হোমস্টের চারপাশটা মনোরম সবুজে মোড়া, যেদিকে চোখ যায় সেদিকেই চা বাগান। আর কাছে-দূরে বেশ কয়েকটা পাহাড়ের অবয়ব। রাত্রে যখন সেই পাহাড়গুলোর গায়ে জোনাকির মত জ্বলে ওঠে বিন্দু বিন্দু আলো, হয়ত কার্শিয়াং, মিরিক বা অন্যান্য গ্রামের আলো, তখন মনে হয় চেয়েই থেকে যাই। এ বাড়ির প্রতিটি কোণ থেকে এমন সুন্দর সবুজে মোড়া পাহাড়, চা বাগান আর গ্রামীন পথ দেখা যায়, চোখ জুড়িয়ে যায়। পরদিন কার্শিয়াং ভ্রমণ। ঈগলস ক্রেগ থেকে শুরু করে ডাউহিলের জঙ্গল, চেনা পথ হলেও বারবার ফিরে আসতে ইচ্ছে করে। বাড়তি পাওনা ডাউহিলের পথে হনুমান টপ আর ‘কার্শিয়াং কে ভালবাসি’ র পাশে ছবি তোলা। ফিরে এসে হোমস্টের ভাত ডাল ভাজা আর ডিমের কারী সহযোগে দুপুরের আহার।

বিকেলের দিকে হোমস্টের আশপাশটা ঘুরতে বেরিয়ে পড়লাম। সিঙ্গেল চা বাগানের অফিসের কাছে একটা পায়ে চলা পথ চলে গেছে পাহাড়ের দিকে। খোঁজ নিয়ে জানলাম এই পথ সোজা চলে গেছে কার্শিয়াং বাজারে। ব্যস, অমনি সে পথে পাড়ি। পাইন বনের ভেতর দিয়ে অনন্য সুন্দর সে পাকদন্ডী পথ পাহাড়ি কয়েকটা গ্রাম পেরিয়ে পৌঁছে গেছে কার্শিয়াং এ বাজারের ঠিক সামনে। পথে পড়েছে নয়নাভিরাম কিছু দৃশ্য। উপত্যকার সূর্যাস্ত এখান থেকেই দু চোখ মেলে দেখেছি। পথচলতি কয়েকজন গ্রামবাসীর কাছে জেনেও নেওয়া গেছে সঠিক পথেই চলছি। শুধু সময়টা মেলাতে গেলেই বিপত্তি। কিছুটা হাঁটার পর কতক্ষন বাকি আছে জিজ্ঞেস করতে জবাব পেলাম দশ-পনেরো মিনিট জোর। তারও আধঘন্টা চলার পর আবার শুনলাম সেই দশ-পনেরো মিনিটই বাকি আছে। সে যাই হোক, হালকা চালে আমাদের সময় লেগেছিল এক ঘন্টার কিছু বেশি। মন ভরিয়ে দিয়েছে সে পথ। ফেরার সময় অবশ্য একটা গাড়িতে মাত্র দুশো টাকায় মূল রাস্তা দিয়ে ফিরে এসেছি। ক্লান্ত শরীরে সঞ্জীমা হোমস্টে পৌঁছতেই এসে গেছে গরম চা আর সুস্বাদু পকোড়া। রাতের চিকেনটাও যথারীতি দুর্দান্ত ছিল। বাড়ির মালিক সঞ্জয় মানগারের আতিথেয়তা অসাধারণ। এপ্রিলের শুরুতে হালকা শীতের আমেজ মেখে দুটো দিন দারুন কাটালাম সঞ্জীমা হোমস্টেতে। এ এক অনন্য অভিজ্ঞতাই বটে!

By Alekh

One thought on “কার্শিয়াংয়ের অদূরে – সমীপেন্দ্র ব্যানার্জী”
  1. সবটা দেখতে পেলাম চোখের সামনে…..
    সত্যি! অনন্য অভিজ্ঞতাই বটে!! 🌸

Leave a Reply to Piyasa Halder Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *