Alekh

চাঁদ ঢলে পড়ছিল পশ্চিম আকাশে। ক্রমে- ক্রমে চাঁদ গিলে নেওয়া ভোরের আলো ছড়িয়ে পড়ছিল এ মাঠ-ঘাট প্রান্তরে। পুবের হাল্কা ঠান্ডা বাতাসে স্নিগ্ধ হচ্ছিল এ পোড়াদেহ। নারীদেহ কেন পুড়ে ওঠে বারবার! মাঠের পরে বাবলার ঝোপ- ঝাড় ডিঙ্গোলেই বাঁদিকে দুটো পলাশ গাছ আর ডানের এক বিশাল অর্জুন গাছ, ঘাসের দল মাড়িয়ে এলেই ঢালটি সুড়সুড় করে টেনে নিয়ে যায় শীর্ণ নদীর বুকের চড়ায়। বালি ছড়ানো সেই ছোট্ট চড়ায়। ইন্দুমতী অন্ধকারে ঘর থেকে রওয়ানা হয়েছে। কোন পুরুষের ঘেরাটোপ বিধিনিষেধ নেই সেই ঘরে। ইন্দুমতীর সারা শরীর অন্তরে- বাইরে জ্বলতে থাকে। নদীর কাছে দেহ জুড়োতে ছুটছে তাই। পুবালী বাতাস আজ ছন্দে- ছন্দে বইছিল শীতলতায়। নদীর উজানে তাকিয়ে থাকে সে। তবুও ইন্দুমতীর এ জ্বলন কমছিল না। ভোরের আধো আলো অন্ধকারে সে উজানে তাকিয়ে কী যেন খুঁজতে থাকে।

পীতাম্বর গুজরাটে পলিমার কারখানায় লেবারের কাজ করত। আগে বছরে ফাঁক- ফোঁকরে নিয়ম করে আসত। বৌকে জমানো টাকা এনে তুলে দিত। তা দিয়ে তার বৌ পরের ফেরা অবধি বেশ খেয়ে- পড়ে থাকত। বাচ্চা দুটোর লেখাপড়া, জামা- কাপড় সবই একটু আধটু হত। বাড়ির একফালি জমিতে সামান্য সব্জী চাষ আর এখানে ওখানে ব্যাপার বাড়িতে ফাইফরমাশ খেটে সংসারটা চালিয়ে নিত। প্রথমে নিয়মে ভাঁটা ফেলল পীতাম্বর। বছরে এক- আধবার আসতে লাগল। তারপর সেই যে উনিশের পুজোর পর গেল, লকডাউন হল, তারপরের অনেকগুলো মাস গড়াল। কোন খোঁজ খবর নেই। পেটে খিদে ঘরের সবার আর শরীর ভেতরে মনে জ্বলতে থাকে ইন্দুমতীর। পঞ্চায়েতের কাছে ত্রাণের চাল আর টাকা নিতে গেলেই পঞ্চায়েত ইন্দুমতীর দিকে এমন করে তাকায় যেন বুঝতে পারে ইন্দুমতী জ্বলছে ভেতরে। একদিন তো নিরিবিলিতে ইন্দুকে একলা পেয়ে তার হাতটি চেপে ধরল যদুনাথ আর বলল— একদিন তো আমায় আদর করে তোর বাড়িতে ডাকতে পারিস। ইন্দুমতীর শরীরের জ্বলনে ভেতর থেকে এ পঞ্চায়েত বুড়োটাকে খুন করবার বাসনা জাগল। ওর আর ওদের ভয়ে ঘরে চুপচাপ লুকিয়ে থাকা।

অসহ্য জ্বালাপোড়া। এ জীয়ন্ত শরীরের। পাশেই কদিন আগেই একটি প্রাণ পুড়ে গিয়ে অপার শান্তি পেয়েছে। এত প্রাণ নিঃসাড় করে দিয়েও তার আজ একদন্ড শান্তি নেই। গায়ের শাড়ি শায়া ব্লাউজ সব খুলে উজানে তাকিয়ে থাকে সে শীতল হতে। এক উলঙ্গ নারী, এক উন্মুক্ত প্রকৃতির প্রাঙ্গণে মিশে যেতে থাকে। এই সময় তার সই মনসুরা সেই শীর্ণকায়া নদীর জলের থেকে উঠে আসে, ইন্দুর বুকের পদ্মবোঁটা মনসুরার হাতের ছোঁয়ায় জেগে ওঠে। মনসুরা ইন্দুকে হাত ধরে জলে নিয়ে চলে। বলে– সই তোর গায়ে রক্তের টাটকা গন্ধ! ধুয়ে দি চল।

ইন্দুমতী বলে- পঞ্চায়েতকে যে হাঁসুয়া দিয়ে কুপিয়েছি তা অর্জুন গাছের তলে ঝোপে রেখে এসেছি। আর দুটো টাটকা শ্বাস এই দু- হাতে রাতের আঁধারে বন্ধ করে দিয়েছি চিরতরে। ওরাও শীতল হয়ে আছে আরও এই ভোরের বাতাসে।

মনসুরা ভালো করে আলো ফুটবার আগেই জলে গা ধুইয়ে চান করিয়ে শাড়ি কাপড় পরিয়ে ইন্দুমতীকে সাথে নিয়ে ভোরের আলোতেই নদীর ওপারে গিয়ে দূরের পথে পাড়ি দেয়। কিছু আলো আর কিছু আঁধার বোধহয় মানব জীবনের সেই পরম রহস্য!

By Alekh

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *