এই মুহূর্তে বিশ্বব্যপী অতিমারী COVID-19 সমগ্র মানব জাতিকে এমন অভূতপূর্ব পরিস্থিতির সম্মুখীন করেছে যে আমাদের দৈনন্দিন স্বাভাবিক জীবন যাত্রায় এক আকস্মিক ছন্দ পতন ঘটে গেছে এবং আমাদের জীবনের ও সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে এই আকস্মিক ছন্দ পতন কিছু অভূতপূর্ব সামাজিক ও নৈতিক দ্বন্দ্বের উত্থাপন করেছে। যেকোন সংক্রামক রোগের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল তার সংক্রমণ ক্ষমতা। তাই এক্ষেত্রে মূল সমস্যার উৎপত্তি স্থল হল একজন সংক্রমিত রোগী এক্ষেত্রে একইসাথে সংক্রমণের শিকার আবার বাহক। তাই রোগটির সংক্রমণ ক্ষমতা শুধু রোগীর সাবধানতা অবলম্বনের ওপর নির্ভর করেনা, বরং তা পারিপার্শ্বিক সকলের সমান সতর্কতা দাবি করে। COVID-19 ইতিমধ্যেই বিশ্বব্যপী অতিমারীর আকার ধারন করেছে তার অতি সংক্রমণ ক্ষমতার বৈশিষ্ট্য এর জন্য। তাই WHO এর পক্ষ থেকে এই মারণ ব্যধী প্রতিরোধে পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখার পাশাপাশি কিছু অত্যাবশ্যক প্রতিরক্ষামুলক ব্যবস্থা হিসাবে ‘আইসোলেসন’, ‘কোয়ারান্টাইন’, ও সামাজিক দূরত্ব পালন করার নির্দেশিকা জারি করা হয়েছে।
এখন এই WHO এর প্রতিরক্ষামুলক নির্দেশিকাগুলি সাধারণ মানুষের উপর হঠাৎ করে চাপিয়ে দেবার ফলে কিছু অভূতপূর্ব নৈতিক ও সামাজিক সমস্যা উত্থাপিত হয়েছ। প্রথমেই আসি ‘আইসোলেসন’ ও ‘কোয়ারান্টাইন’ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে। স্বাস্থ্য পরিষেবার পক্ষ থেকে এই জরুরী পদক্ষেপ নেওয়া হয় এই দ্রুত সংক্রমণ কে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য। কিন্তু এই পদ্ধতির কিছু অসুবিধা হল এই পদ্ধতিতে অনেক ক্ষেত্রে বহু মানুষকে রোগের সঠিক সনাক্তকরণ ছাড়াই একসাথে থাকতে বাধ্য করা হয় যেমন কোন একটি নিদিষ্ট কেন্দ্রে একত্রে অনেক মানুষকে আলাদা করে রাখা হয় এবং এর ফলে ওই অঞ্চলের কিছু অসংক্রমিত ব্যক্তিরও সংক্রমিত হবার আশংকা থেকে থাকে। এখন এই অবস্থাকে অনেক সময় দার্শনিক John Stuart Mill র ‘ক্ষতিপূরন-মূলক’ যুক্তি (Harm Principle) দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় যার মতানুসারে, স্বল্প সংখ্যক মানুষের ক্ষতি বা ত্যাগের পরিবর্তে সমগ্র জনস্বাস্থ্য কল্যাণের ন্যায্যতা প্রতিপাদন করা হয়। যেভাবে যুদ্ধ ক্ষেত্রে সৈনিকদের বলিদানের অবদানে সমগ্র দেশের সুরক্ষা নিয়ন্ত্রত হয়। কিন্তু এই নীতি কখনওই সব ক্ষেত্রে সমভাবে প্রযোজ্য নয় বিশেষত যেখানে সমগ্র সাধারন মানুষের জনস্বাস্থ্য বিপন্নতার সম্মুখীন। এই নীতি দার্শনিক John Rawls র সাম্য ও ন্যায্য বণ্টন নীতির সম্পূর্ণ বিরোধী। রলসের তত্ত্ব অনুসারে, প্রতিটি মানুষেরই জাতি, ধর্ম, বর্ণ, বিত্ত নির্বিশেষে সমান চিকিৎসা পাবার মানবিক অধিকার আছে যদিনা সমর্থনযোগ্য কোন যুক্তিতে বিভাজন হয়। বিষয়টি একটি দৃষ্টান্ত দিয়ে ব্যাখা করে যেতে পারে, দুজন রোগী প্রাথমিক ভাবে তাদের জাতি, ধর্ম, বর্ণ, বিত্ত নির্বিশেষে সমান চিকিৎসা পাবার অধিকারী। তবে প্রাথমিক চিকিৎসার পরে যদি নির্ধারিত হয় যে তাদের মধ্যে একজন অপেক্ষাকৃত বেশি অসুস্থ তখন সেই ব্যক্তিকে অতিরিক্ত চিকিৎসা প্রদান করা হয়। কিন্তু এই বিশ্বব্যপী অতিমারীর প্রভাব স্বাভাবিক আর্থসামাজিক পরিকাঠামোকে অত্যন্ত দ্রুত ও আকস্মিক গতিতে এ্মনভাবে বদলে দেয় যে সমন্যায় বন্টন নীতি আর কার্যকরী হয় না যেখানে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে সীমিত চিকিৎসা পরিষেবার মাধ্যমে সামাল দিতে হয় বিশাল সংখ্যক আক্রান্ত মানুষকে।
দ্বিতীয়ত, এই প্রতিরক্ষামুলক ব্যবস্থা গুলি সমগ্র জনকল্যাণের স্বার্থে গ্রহণ করা হলেও সাধারন মানুষের পক্ষে এগুলি মেনে চলতে অসুবিধা হয়, কারন এক্ষেত্রে একজন মানুষের স্বাভাবিক চালচলন ও স্বাধীনতার ওপর হঠাৎ করেই কিছু বিধিনিষেধ চাপিয়ে দেওয়া হয় যা সরকার বা প্রশাসন দ্বারা ব্যক্তি স্বাধীনতার হস্তক্ষেপ বা লঙ্ঘন বলে বিবেচিত হতে পারে, যেমন গৃহবন্দী অবস্থা, নাক মুখ ঢেকে রাখা। একইভাবে চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্য পরিষেবা এবং পুলিশ প্রশাসনের সাথে জড়িত সকল ব্যক্তিকেও তাদের পরিবার থেকে দূরে আলাদা বাসস্থানে থাকতে বাধ্য করা হয়েছে নিরাপত্তার কারনে। এক্ষেত্রে জনসাধারণের কাছ থেকে পূর্ববর্তী কোন অনুমোদন (Informed Consent) নেওয়া হয়ে ওঠে না সময় ও জরুরি অবস্থার তীব্র চাপে। আকস্মিক পরিস্থিতির ভয়াবহতা ও সংক্রমণের দ্রুত প্রসারতা প্রশাসন কে এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করে সমগ্র জনকল্যাণের স্বার্থে, কারন এই পরিস্থিতিতে সমগ্র জনস্বাস্থ্য সুরক্ষাই প্রথম ও প্রধানতম কর্তব্য হিসাবে নৈতিক ও সামাজিক দিক থেকে যুক্তিযুক্ত বলে বিবেচিত হয়। যদিও সামাজিক জীব হিসাবে সাধারন মানুষের পক্ষে এই সামাজিক দূরত্ব পালন ও পরিবহন ব্যবস্থার অচলাবস্থাকে শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক ভাবে অসহনীয় বলে মনে হতে পারে কিন্তু আমাদের বুঝতে হবে কেন এই দূরত্ব এই অতিমারী মোকাবিলার পক্ষে অত্যাবশ্যক। এই যুক্তিটি আমি দুভাবে বিশ্লেষণ করব। প্রথমত, একজন বিচারবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের তার নিজের প্রতি কিছু কর্তব্য বর্তমান যাকে দার্শনিক Immanuel Kant প্রাকৃতিক কর্তব্য বলেছেন, এই যুক্তি অনুসারে একজন বিচারবুদ্ধি সম্পন্ন ব্যক্তির নিজের প্রতি প্রাথমিক ও সার্বজনীন কর্তব্য হল নিজেকে সুরক্ষিত ও সংরক্ষিত করা। এই যুক্তি অবলম্বনে একজন বিচারবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের প্রাথমিক কর্তব্য হল সেই সকল প্রতিরক্ষামুলক ব্যবস্থাগুলি মেনে চলা যা এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে নিজেকে সুরক্ষিত রাখবে। দ্বিতীয়ত, একজন সামাজিক নাগরিক হিসাবে প্রত্যেক ব্যক্তির অন্য ব্যক্তির প্রতি একটি সামাজিক দায়বদ্ধতা বর্তমান। এই সামাজিক দায়বদ্ধতা দুভাবে আসে, এক অপরের প্রতি কোন ক্ষতিসাধন না করে ও দুই অপর ব্যক্তির কোন উপকার সাধন করে। এই দুটি দায়বদ্ধতাই এখন আমরা পালন করতে পারি অপরের সাথে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে, কারন এইভাবে আমরা একইসাথে অন্যকে সংক্রমিত হবার থেকে রক্ষা করব ও তার সামগ্রিক স্বাস্থ্যের উন্নতি সাধন করব। আমরা যদি সামাজিক দূরত্ব কথাটিকে বাহ্যিক দূরত্ব হিসাবে গ্রহণ করি, তাহলে হয়ত আমাদের এটি মানতে আরও সুবিধা হবে, কারন এখানে সমাজ থেকে আমাদের পৃথক করা হচ্ছেনা বরং এই জরুরি অবস্থার মোকাবিলায় আমরা এই বাহ্যিক দূরত্বটা যদি সম্মিলিতভাবে পালন করি তাহলে সেটাই হবে আমাদের সামাজিক একতার পরিচায়ক। তাই যেখানে সমগ্র মানব জাতি অস্তিত্ব সংকটের মুখে, সেখানে এই জরুরি অবস্থার মোকাবিলায় প্রতিরক্ষামুলক ব্যবস্থাগুলি স্বেচ্ছায় পালন করা মানুষ হিসাবে আমাদের নৈতিক ও সামাজিক কর্তব্য। তবে প্রতিরক্ষামুলক ব্যবস্থাগুলি পালন করতে গিয়ে কিছু মানুষ ভীতির বশবর্তী হয়ে সরকারের বারংবার প্রয়োজনীয় পরিষেবা চালু রাখার আশ্বাস সত্ত্বেও প্রয়োজনের অতিরিক্ত জিনিস ক্রয় করা শুরু করেছে ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তার কথা ভেবে। যার ফলে বিভিন্ন জায়গায় প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রী কম হতে শুরু করেছে বিশেষত সাবান ও স্যানিটাইজার। এখন বিষয়টা হল আমাদের বুঝতে হবে যে, যেহেতু এটি গোষ্ঠী সংক্রামক ব্যধী তাই একা বা একজনের পরিচ্ছন্নতা অবলম্বন করার ভিত্তিতে এই সংক্রমণ প্রতিরোধ হবে না। এই অভূতপূর্ব ভয়াবহ পরিস্থিতিকে মোকাবিলা করার জন্য আমাদের নিজেদের বিচারবুদ্ধি ও স্থৈর্যকে বজায় রাখতে হবে। এই প্রসঙ্গে গ্রীক দার্শনিক Aristotle র সঠিক মাত্রা অবলম্বন করার কথা আমি বলব। অ্যারিস্টল্টলের মতানুসারে একজন নৈতিক বিচারবুদ্ধি সম্পন্ন ব্যক্তি যেকোন পরিস্থিতিতে সংযম বজায় রাখতে পারে সঠিক মাত্রা অবলম্বন করে। সঠিক মাত্রাবোধ একজনকে দুই চরম সীমার মধ্যবর্তী অবস্থানে অবিচল থাকতে শেখায় এবং পরিস্থিতির গুরুত্ব বিচার করে সেই অনুযায়ী নৈতিক সিদ্ধান্ত অবলম্বন করার বলে। অ্যারিস্টল্টলের এই সঠিক মাত্রার তত্ত্ব আমাদের যেকোন সমস্যায় স্থিতবুদ্ধি সম্পন্ন হবার শিক্ষা দেয়। এই জরুরী অবস্থার মোকাবিলা করার জন্য স্থিতবুদ্ধি সম্পন্ন সংযমী হওয়া অত্যন্ত প্রয়োজন কারন ভীতি ও অতিরিক্ত চিন্তা মানুষের স্বাভাবিক বুদ্ধি ও চিন্তা করার ভারসাম্যকে নষ্ট করে ও পরিস্থিতিকে জটিলতর করে তোলে। তাই এই পরিস্থিতির মোকাবিলার জন্য স্থিতধী হওয়া অত্যন্ত প্রয়োজন। ভীতির বশবর্তী হয়ে আমরা হয়ত সংক্রামক ব্যক্তিদের প্রতি অত্যন্ত রূঢ় আচরণ করে ফেলছি যা হয়ত আমাদের সামাজিক ভারসাম্যকে আরও নষ্ট করছে। গত বছর মহারাষ্ট্রের এক ব্যক্তিকে করোনা রোগী সন্দেহে গণপ্রহারে মেরে ফেলা হয়েছে,বহু মানুসকে অকারণে সামাজিক ভাবে সামগ্রিক হেনস্থা করা হয়েছে। এটি অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা। আমাদের এটা উপলব্ধি করা দরকার যে সংক্রমিত রোগীরা কোন দাগী অপরাধী নয় এবং তাদের এই অবস্থার জন্য তারা নিজেরা দায়ী নাও হতে পারেন। আবার সাধারণ হাঁচি কাশি ও জ্বরের সাথে করোনা ভাইরাসের কিছু লক্ষণের সাদৃশ্য থাকলেও এ সবগুলি সমগোত্রীয় নয়। তবে আবার একজন করোনা আক্রান্ত রোগীকে গণপ্রহারের মাধ্যমেও করোনা সংক্রমণের সম্ভাবনা আছে। তাই প্রয়োজনীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অবলম্বনের সাথে সাথে আমরা তাদের প্রতি হয়ত আর একটু সহানুভূতিশীল হতে পারি, কারন তারা অনেকেই হয়ত এখন তাদের প্রিয়জনের থেকে বহুদূরে থেকে জীবনের শেষ লড়াই লড়ছেন। রোগকে ঘৃণা করলেও রোগীকে কখনওই ঘৃণা করা উচিৎ নয়। তাই ঘৃণা, ভীতি বা হিংসা নয় বরং একটু সহমর্মিতা ও একতাই এই পরিস্থিতিকে অনেক সহজ করে তুলতে পারে।
তৃতীয়ত, যেকোন সংক্রামক ব্যধী আরও বেশি সংক্রমিত হয় কোন দেশের আর্থসামাজিক অসাম্যের কারনে এবং যেকোন মহামারী এই আর্থসামাজিক অসাম্যতাকে আরও বেশি করে প্রকট করে তোলে।অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ ও অপুস্টিকর খাদ্যাভাস, পরিশুদ্ধ পানীয় জলের অভাব করোনার মত মহামারীকে আরও প্রবণতা দেয়। ভারতবর্ষের মত উন্নয়নশীল দেশে যেখানে বেশীরভাগ মানুষই দারিদ্র সীমার নীচে অবস্থান করে, একসাথে পঞ্চাশ থেকে একশ জন ছোট্ট পরিসরে কোনমতে মাথা গোঁজে ও দৈনিক কাজের ভিত্তিতে গ্রাসাচ্ছাদন করে, সেখানে সামাজিক দূরত্ব পালন করা হয়ত এক অবাস্তব কল্পনা। সরকার থেকে সারা দেশব্যপী লকডাউন ঘোষণার পর আগের বছর পরিযায়ী শ্রমিকরা যেভাবে মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে তাদের গন্তব্যে পৌঁছছেন তা যেকোন সভ্য গণতান্ত্রিক দেশের পক্ষে অত্যন্ত লজ্জার ও অসাম্যতার জ্বলন্ত প্রতিচ্ছবি। কেউ কেউ এই অমানুসিক পরিশ্রমে মারা যাচ্ছেন। এই সকল নির্মম ঘটনা অত্যন্ত হৃদয়বিদারক ও কখনওই কাম্য নয়। এ অবস্থায় প্রতিটি রাজ্য যদি ব্লক হিসাবে বিভক্ত হয়ে দারিদ্র সীমার নীচে যারা অবস্থিত এবং যারা পরিযায়ী শ্রমিক তাদের সনাক্ত করে সরকার থেকে তাদের প্রয়োজনীয় খাদ্য, বাসস্থান ও দ্রব্য সামগ্রী সবারহের ব্যবস্থা নেয় তাহলে হয়ত পরিস্থিতি কিছুটা আয়ত্তে আসতে পারে ভবিষ্যতে। সাথে সাথে সাধারণ মানুষ ও যদি তাদের সাধ্য অনুযায়ি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় তাহলেও এই সম্মিলিত প্রচেষ্টায় পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসতে সম্ভব। অশিক্ষা, অসচেতনতা ও দারিদ্র এই তিনটি বিষয় যে কোন দেশকে আরও সংক্রমণ প্রবণ করে তোলে। তাই এই অতিমারীর অতি সংক্রমণ বিষয়ে সাধারন মানুষকে সচেতন করা তোলা সরকার, গণমাধ্যম ও প্রতিটি বুদ্ধিবৃত্তি সম্পন্ন মানুষের আশু কর্তব্য। তবে এক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে যাতে কোনভাবেই অযৌক্তিক অমূলক খবর জনসাধারণের মধ্যে না পৌঁছোয় যা এই পরিস্থিতিতে আরও আতঙ্ক সৃষ্টি করতে পারে, তাই যেমন যুক্তিযুক্ত, বৈজ্ঞানিক ও প্রমাণভিত্তিক তথ্য সরবারহ করার মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন, তেমনই প্রয়োজন ভিত্তিহীন অহেতুক আতঙ্ক উৎপাদক খবরের নিয়ন্ত্রণ।
অতিমারীর সংক্রমণ প্রতিরোধে জরুরী অবস্থায় প্রতিরক্ষামূলক নীতিগুলি সাধারনত সামগ্রিক জনকল্যাণের স্বার্থে জনগণের উপর প্রয়োগ করা হয়, তবে তার সফল প্রয়োগের জন্য জনগণের বিশ্বাস অর্জন করা প্রয়োজনীয়, তাদেরকে উপলব্ধি করানো প্রয়োজন যে এই সকল নীতি তাদের কল্যাণের জন্যই গ্রহণ করা হয়েছে, আর এই বিশ্বাস ও উপলব্ধি একমাত্র গড়ে উঠতে পারে নীতি গুলির প্রয়োগে সততা, স্বচ্ছতা ও সার্বজনীনতা বজায় রাখার মাধ্যমে। এই নীতিগুলি তখনই সাধারণ মানুষ পালন করবে যখন সমাজের প্রতিটি স্তরে জাতি, বর্ণ, ধর্ম নির্বিশেষে নীতিগুলি সমভাবে প্রযোজ্য হবে, শুধু কেবলমাত্র যারা জরুরী পরিষেবা ব্যবস্থার সাথে যুক্ত আছে তারা ছাড়া। তাদের মধ্যে পড়ছেন চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্য পরিষেবার সাথে জড়িত সকল ব্যক্তি, পুলিশ প্রশাসন এবং খাদ্য ও প্রয়োজনীয় পরিষেবা সরবারহের সাথে যুক্ত ব্যক্তিরা, যারা নিজের জীবন তুচ্ছ করে দিনের পর দিন পরিবারের থেকে দূরে থেকে এই ভয়াবহ পরিস্থিতির মোকাবিলা করছেন, তারা সত্যিই কুর্নিশের যোগ্য। ব্যক্তিগত স্বার্থ ও নিজেদের পরিবারের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতাকে দূরে সরিয়ে রেখে তারা সমাজের প্রতি তাদের এই অনন্য ভূমিকা পালন করছেন সামগ্রিক কল্যাণকে অগ্রাধিকার দিয়ে।
পরিশেষে আসি চিকিৎসক ও সমগ্র স্বাস্থ্য পরিষেবার বিষয়ে। চিকিৎসা ব্যবস্থার ক্ষেত্রে মূলত প্রত্যেকটি রোগীকে পৃথক ভাবে তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী চিকিৎসা করা হয় কিন্তু বর্তমান জরুরী পরিস্থিতিতে এই ব্যক্তিভিত্তিক পরিষেবা ও সমন্যায্য বণ্টন নীতি কোনভাবেই প্রদান করা সম্ভবপর নয়। চিকিৎসক ও সমগ্র স্বাস্থ্য পরিষেবার ক্ষেত্রে এই জরুরী পরিস্থিতির নীতিসম্মত মোকাবিলা করাই সবথেকে বড় চ্যালেঞ্জঃ কিভাবে ন্যায়সম্মত ভাবে স্বল্প চিকিৎসাসামগ্রীর মাধ্যমে অত্যধিক রোগীকে পরিষেবা প্রদান করা যায়। এই অতিমারী বিশ্বব্যপীতা যে মারাত্মক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে তা অনায়াসেই দুই বিশ্বযুদ্ধের কথা মনে পড়ায় এবং এক্ষেত্রেও চিকিৎসা ব্যবস্থার পক্ষে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে জনস্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষকে হয়ত যুদ্ধকালীন তৎপরতায় সিদ্ধান্ত নিতে হবে ‘ট্রায়াজ’ পদ্ধতি অনুসারে। এই পদ্ধতি অনুসারে যুদ্ধক্ষেত্রে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয় বহু সংখ্যক আহত সৈনিকের মধ্যে কোন সৈনিকের চিকিৎসা আগে করা হবে এবং এই সিদ্ধান্ত গ্রহন করা হয় যুদ্ধ ক্ষেত্রে সৈনিকের উপযোগিতার ভিত্তিতে। অতিমারীর ভয়াবহতা যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির সাথে তুলনীয় হলেও দুটি পরিস্থিতির মধ্যে তফাৎ বিদ্যমান। এই জরুরি পরিস্থিতি যেহেতু জনসাধারনের স্বাস্থ্য ভিত্তিক তাই এই পরিস্থিতিতে একমাত্র সেই নীতিই ন্যায্য হবে যা চিকিৎসা ক্ষেত্রে অধিক প্রাসঙ্গিকতা ও মান্যতা পাবে। সেই যুক্তিতে এই চিকিৎসা পরিষেবায় সর্বপ্রথম অগ্রাধিকার পাবেন চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য পরিষেবার সাথে যুক্ত ব্যক্তিরা যেহেতু তারা সংক্রমিত রোগীর চিকিৎসা করছেন তাই তাদের সংক্রমিত হবার সম্ভাব্যতা সর্বাধিক এবং তারা সংক্রমিত হলে তাদের মাধ্যমে অন্য রোগীর সংক্রমন ঘটতে পারে। তারপর একই যুক্তিতে প্রাসঙ্গিকতা ও মান্যতা পাবে পুলিশ প্রশাসন এবং খাদ্য ও প্রয়োজনীয় পরিষেবা সরবারহের সাথে যুক্ত ব্যক্তিরা যেহেতু তারা অনেক ব্যক্তির সাক্ষাতে আসছেন তাই তারা সংক্রমিত হলে তাদের মাধ্যমে বহু ব্যক্তির সংক্রমণ ঘটার সম্ভব্যতা বর্তমান। একই যুক্তিতে যে সকল ব্যক্তি বহু লোকের সংস্পর্শে আসেন তারা অগ্রাধিকার পাবেন তা সে কোন ‘পাবলিক ফিগার’ হতে পারেন বা এমন কোন ব্যক্তি হতে পারেন যিনি বহু লোকের সাথে একইসাথে বসবাস করেন, তিনি সংক্রমিত হলে তার মাধ্যমে পারিপার্শ্বিক অনেক সংখ্যক লোকের সংক্রমণের সম্ভবনা বর্তমান, এ প্রসংঙ্গে উল্লেখ্য মুম্বাইয়ের ধারাবি অঞ্চল অত্যন্ত সংক্রমণ প্রবণ। এছাড়াও গর্ভবতী নারী যারা অন্য আর একটি প্রাণ নিজ শরীরে ধারণ করছেন তারা সংক্রমিত হলে অবশ্যই চিকিৎসার অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য। ‘ট্রায়াজ’ নীতি অনুযায়ী সংক্রমনের হার দ্রুত বাড়লে এমারজেন্সী পরিষেবায় সেইসকল রোগীদের ICU ও অতিরিক্ত পরিষেবা দিতে হবে যাদের অপেক্ষাকৃত অধিক নিরাময়ের সম্ভাবনা আছে তুলনায় যাদের নিরাময়ের সম্ভাবনা ক্ষীন। এই পরিস্থিতি যদিও একমাত্র সংক্রমণের চরম সীমাতেই প্রযোজ্য। আমাদের বিপুল জনসংখ্যার দেশে সেই চরম সংকট কি ভয়ানক রূপ নিতে পারে, এখন হয়ত আমরা তা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করছি। প্রশাসন ও জনসাধারণকে একত্রে সম্মিলিত ভাবে এই সঙ্কটের মোকাবিলা করতে হবে একতা, সততা ও স্বচ্ছতার মাধ্যমে। আশা রাখি,এই তিনটি নৈতিক ও সামাজিক গুণের যথাযথ মেলবন্ধনেই আমরা এই বিশ্বব্যপী অতিমারীর করাল থাবা থেকে পৃথিবীকে আবার মুক্ত করতে পারব। সকলের আরোগ্য ও সুস্থতা কামনা করি।
প্রশস্তি পন্ডিত, অধ্যাপিকা, দর্শন বিভাগ, পশ্চিমবঙ্গ উচ্চ শিক্ষা বিভাগ