Alekh

অপূর্ব রঙ্গারুনে এসেছে । ছোট্ট গ্রাম, পেছনে পাইনের জঙ্গল আর সামনে বিস্তীর্ন চা বাগান । দু’টো হোমস্টে আছে। মার্চের শুরুতে ভালই ঠান্ডা আছে । টুরিস্টরা এখানে পৌঁছোয় না বড় একটা। সবসময় ট্রেক করার সঙ্গী পাওয়া যায় না বলে অপূর্ব একাই দু’এক দিন ছুটি নিয়ে এসব জায়গায় চলে আসে । চল্লিশে পা দেওয়া ব্যাচেলার অপূর্ব নিজেকে মাঝেমধ্যে এসব ট্রিট দেয় ।

চেহারা বেশ সুঠাম, উচ্চতা চোখে পড়ার মতো । কথাবার্তাতেও বেশ পালিশ । তবে সমবয়সীরা আওয়াজ দেয়, এই বয়সেও ভেসে ভেসে বেড়াচ্ছে বলে । ওর মতে, যথেষ্ট প্রতিষ্ঠিত না হতে পারলে পাকাপাকি সম্পর্কে কোনও মেয়ে জড়াতে চায় না । অপূর্ব কাজ একটা করে বটে, তবে পনেরো বছর পর সেখানে আলাদা কোনও মোটিভেশান নেই ।

হুগলির গ্রামের ছেলে অপূর্ব কলেজের সময় থেকে মামার কাছে মানিকতলায় থাকে । স্কুল জীবনে পড়াশোনায় ভালই ছিল । অবস্থাপন্ন ঘরের বন্ধুরা ব্যাঙ্গালোরে গেল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে । অপূর্ব ঢুকল গ্রাজুয়েশানে। পরে কম্পিউটারের সার্টিফিকেশান করে কাজকর্ম জোগাড় করেছে । ততদিনে কর্মক্ষেত্রে বেসরকারি কলেজের ইঞ্জিনিয়ারদের দাপট শুরু হয়েছে ।

ভাবতে ভাবতে চোখে পড়ল অদ্ভুত একটা দৃশ্য । একটা মেয়ে হোমস্টেতে একা ঢুকছে লাগেজ ব্যাগ নিয়ে।

একা ঘোরার ব্যাপারটা বেশ সুবিধের, কোনও ব্যাগেজ নেই … যেমন খুশি চলাফেরা যায় । কিন্তু এমনভাবে কোনও মেয়েকে আগে দেখেনি অপূর্ব । ট্রেকিং রুটে বিদেশি মেয়েদেরও দেখেছে, হয় দল বেঁধে অথবা ছেলে বন্ধুর সাথে ।

এমনিতে হোমস্টে এখন ফাঁকা, অপূর্ব আর মেয়েটা । লাঞ্চের সময় আলাপ হল। কলকাতার বাইরে এলে দুজন বাঙালির ফর্মালিটি না করলেও চলে ।

-একা ঘোরার অভ্যেস আছে ?

-অভ্যেস নেই, সেজন্যেই…

-হঠাৎ পোকা নড়ল !

-ট্রুথ ইজ স্ট্রেঞ্জার দ্যান ফিকশন

অপর্নার ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত । অনেকদিনের স্টেডি সম্পর্কের পর সামনের মাসে বিয়ে । মুশকিল যেটা, হলিউডের সিনেমার মতো সোলো ট্রিপের আইডিয়াটা নিয়ে ।

বাড়িতে অশান্তি করে এই একবগগা পাহাড়ি রাস্তায় এসে ততোটা আত্মবিশ্বাস অবশিষ্ট ছিল না অপর্নার । অপূর্বের সাথে আলাপ হওয়াতে খানিকটা স্বস্তি পেল যেন ।     

হবু বরের  ইগোতে খানিকটা আঘাত লেগেছে, সেও একা রওনা হয়েছে দার্জিলিং । ভেবেছে একসাথে ফেরা যাবে। কথাটা শুনে হেসে ফেলল অপূর্ব ।

পরের দিন এক্সপিডিশানের প্ল্যান হল । এখান থেকে বেশ খানিকটা জঙ্গলের পথে হেঁটে গেলে দার্জিলিং পর্যন্ত যাওয়া যায় । শুনে বেশ উৎসাহিত হল অপর্ণা । আর অপূর্ব তো পাঁচ পা বাড়িয়েই আছে । তবে অপর্ণার বিরহী যক্ষটির কথাও মনে করাতে সে ভুলল না ।

সকালবেলা চারপাশের জমাট নিস্তব্ধতার মধ্যে শুকনো পাতায় দু’জনের পায়ের শব্দ শোনা যেতে লাগলো । পায়ে চলা পথ ধরে দু’জন হাঁটছিল ।

ক’ঘন্টা নির্জন রাস্তায় চুপ করে হাঁটা যায় না। দু’জনে জীবনের বহু কথা বলে ফেলল । যা এতদিন বলার দরকার হয়নি । চেনা পরিবেশের বাইরে বেরোলে সাধারণ কথাগুলো গল্পের মতো হয়ে যায়, বলল অপূর্ব । অপর্ণা হেসে বলল, তাহলে নিজেদের গল্পগুলো এই পাইনের জঙ্গলে রাখা থাক ।

গাইড না থাকালেও চলাটা যে ঠিক পথে হচ্ছে বুঝতে পেরেছে অপূর্ব । হোমস্টের মালিকের থেকে মোটামুটি পথের আন্দাজ যা পেয়েছিল, সেই হিসেবমতো ছোট নদীটার ধারে এসে পড়ল ওরা । এর আগে অবশ্য অপর্ণা একবার পা ফসকে পড়ে গেছিল, তাকে বীরপুরুষের মতো তুললেও কিছুদূরে একটা গর্তে পা পড়ে মুচকে গেছে অপূর্বের পা । এখন বেশ টনটন করছে ।

গাছের তলায় একটা পাথরে সিঁদুর লেপা দেবতা। দেখে দু’জন দাঁড়িয়ে পড়ল । অপর্ণার মনে হচ্ছে, নদী পেরিয়ে আরও হেঁটে দার্জিলিং পৌঁছে লাভ কি ! অপূর্ব ভাবল, পথটা না ফুরোলেই ভাল হতো ।

জীবনের কিছু মুহূর্ত যেন হারিয়ে গেছে ওদের।

ঠিক সেই সময়েই শুকনো পাতায় অসময়ের বৃষ্টির ফোঁটা ঝরে জঙ্গলে একটা অদ্ভুত গন্ধ উঠতে শুরু করেছে।

By Alekh

One thought on “ইন্টারভ্যাল – বৈদূর্য্য সরকার”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *