Alekh

রবীন্দ্রনাথের তো বিশ্বজোড়া পথ। কোন পথে প্রথম তিনি কার ভেতরে আসেন সেটা কি সে ই বলতে পারে? তবু আজ হঠাৎ খুব ইচ্ছে হল ভাবতে, তাঁকে প্রথম নিজের করে পেলাম কবে। বিদগ্ধ বন্ধুরা অসন্তুষ্ঠ হলেও কিচ্ছু করার নেই….. নিজেরই বলব!

আমাদের বাড়ির কাছে হাইস্কুল ছিল না… ছিল জুনিয়র হাই। তা হোক সেই আমার স্বপ্নের কারখানা।সেখানে কত বন্ধু, হেডস‍্যর বামদেববাবুর চোখে প্রশংসা…..এক নতুন আলো পৃথিবীর খবর! পাঠ‍্যবইতে রবীন্দ্রনাথ তো সব ক্লাসেই থাকতেন, সন্ধেবেলা দুলে দুলে মুখস্তও করত সবাই। তাহোক তবু সেই একঠেঙে তালগাছ বাএসেছে শরৎ ঠিক ততটা আমার হয়ে ওঠেনি। আমাদের সেই গ্রামে তখন রবীন্দ্রজয়ন্তীর খুব বাড়াবাড়ি ছিল না বোধহয় তাই মাইকের সামনে নিজেকে মনে পড়ে না। অন‍্য কবিদের সঙ্গে তিনিও ছিলেন এই পর্যন্ত।
আমার যখন ক্লাস এইট মানে সেবছরই এই স্কুলের শেষ বছর তিনি এলেন মহাসমারোহে। ততদিনে ক্লাসমনিটর, ফাস্টগার্ল ইত‍্যাদিতে নিজের ভেতর আলাদা একটা আলো টের পেতাম। তখন বোঝার বুদ্ধি ছিল না যে সেটাই ছিল পাপড়ি খোলার দিন।রোজ রোজ নিজের কাছে নিজে নতুন হয়ে উঠছি। সেবার তিনজন স‍্যর মিলে ঠিক করলেন,নাটক হবে স্কুলে।তাঁরাই শিখিয়ে পড়িয়ে নেবেন। নাটকের নাম ঠিক হল ‘কাবুলিওয়ালা’
নামভূমিকায় আমি। আমার যে একটা মনের আকাশ তৈরী হচ্ছে, তা বোধহয় টের পেয়েছিলেন ওনারা।
স্কুলছুটির পর চলত রিহার্সাল! ডায়লগ বলতে যে কি ভাল লাগত! সেই কাবুলিলোকটার ভেতর আমি ঢুকে পড়লাম। মাস্টারমশাইরা এতটা আশা করেন নি। তাই আমার ওপর ভার পড়ল মিনিকে ট্রেনিং দেওয়ার। মিনি হয়েছিল আমারই খুড়তুতো বোন… একবাড়িতে থাকি তাই সে না চাইলেও তাকে টেনে টেনে আনতাম অভ‍্যেস করানোর জন‍্যে। অভিনয়ের সেই সময়ে আমার পিঠে যেন নতুন দুটো ডানা গজাল! আর রবীন্দ্রনাথকে খুব নিজের লাগতে লাগল। আমার প্রথম উন্মোচন ঘটালেন তিনি। আর সেই শুরু আমার আশ্চর্য আলো দেখতে পাওয়ার।
তারপর দুটো স্টেশন পেরিয়ে বড় স্কুলে যাওয়া। প্রথম বছর মানে ক্লাস নাইনেই দিদিমণি বলে দিলেন এবার সবার সামনে কে আসতে পার দেখি… এই স্কুলে এতদিন যে প্রথম হচ্ছে সে, অন‍্য স্কুল থেকে আসা নতুন মেয়ে নাকি আগের বছর অনুত্তীর্ণ ছাত্রীরা কেউ?একটু সঙ্কুচিত হলাম, এসব লড়াই টড়াই ভাল্লাগে না।
তারপর একদিন বাংলা ক্লাসে শিপ্রাদি ‘ রাজর্ষি ‘ পাঠ করতে বললেন। রবীন্দ্রনাথ তখন আমায় ছুঁয়ে আছেন, তাই আমার পাঠ মুগ্ধ করল দিদিকে। ব‍্যস আমি তখন বিশেষ আমি হয়ে গেলাম ক্লাসে। আমার মুখে কার আলো পড়েছিল তা আজ বুঝতে পারি… সেদিনের সেই আনন্দবিহার জীবনের ভিত গড়ে দিল। সেবছরই হল ‘ বিসর্জন ‘ নাটক। আমি জয়সিংহ । রঘুপতি যে হয়েছিল সেই সংঘাকে খুব ভালবাসতাম সুন্দর গান গাইত বলে। নাটকে তার চোখের তলায় রক্তাভা দিয়ে লম্বা চুল চূড়ো করে বেঁধে লাল পোশাক পরে সে যখন দাঁড়াল আমি অবাক। একটু লজ্জা লজ্জা করত অপর্ণার সঙ্গে যে অন্তর্লীন প্রমের অনুভব আছে সেটা বুঝতে পেরে। সেই অনবদ‍্য সংলাপগুলো আমার নিজের হয়ে আছে আজও!
‘ ফুল নে মা, ফুল নে, আর রক্ত না মা, আর রক্ত নয়। এ ও তো রক্তের মত রাঙা জবাফুল ‘। কান্নাটা গলার কাছে রুদ্ধ করে সেই আর্ত স্বর কাউকে শিখিয়ে দিতে হয় নি। শিখিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ! সেই কিশোরীর হৃদয়কে তিনি এমনভাবে স্পর্শ করেছিলেন যে সেই গৌরব তার সর্বত্র ফুটে উঠছিল। আমার নতুন জন্ম হচ্ছিল রোজ।
শুধু একটা গড়বড় হয়েছিল…. জয়সিংহ হয়ে মরে পড়েই আছি। হাততালির ঝড় উঠেছে, পর্দা পড়ে গেছে কিন্ত আমি চোখ বন্ধ অনড়। আমাকে ডেকে বলতে হয়েছিল, ওরে ওঠ পর্দা পড়ে গেছে।
রবীন্দ্রনাথ আমায় নিজেকে ভালবাসতে শেখালেন। আর মনের ভেতরে এত বৈভব জমছিল বলে বাইরের কোন আনন্দ আকর্ষণ করত না। সেই বয়সে অনেক সহপাঠীরাই টপাটপ প্রেমে পড়ে যাচ্ছিল আর আমার বদনাম হল আমি নাকি খুব অহঙ্কারি!
দিদিমণিরা অবশ‍্য এটাকে সুনাম মনে করতেন! সমস‍্যা হল একদিন যখন ট্রেনে করে যেসব মেয়েরা যাতায়াত করে তাদের সবাইকে ডেকে পাঠানো হল স্টাফরুমে। তাদের নামে নাকি নানা কথা রটছে…. এখন এই বয়সে পড়াশোনা ছেড়ে তারা যদি গোল্লায় যাওয়ার চেষ্টা করে, তাহলে তাদের শাসন করে সঠিক পথে আনার কাজটা দিদিমণিদেরই করতে হবে!
তো সেই সভায় আমিও মাথা নিচু করে শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে, আমাকে বলা হল তোর কোন ভয় নেই আমরা জানি তুই কাউকে পাত্তা দিস না। হ‍্যাঁ এরকমই চলবি, তবে তোকে দায়িত্ব দেওয়া হল তুই অন‍্যদের দিকে নজর রাখবি আর কোন বেচাল দেখলে আমাদের রিপোর্ট করবি। আমার তো কান্না পেয়ে গেল! ওরাই তো আমার বন্ধু ওদের নামে নালিশ করব! মাথায় আকাশ নিয়ে বাড়ি ফিরছি হঠাৎ ঝড় উঠল পথে। সেটা কাল বৈশাখীর দিন… ধুলো উড়িয়ে প্রায় অন্ধকার হয়ে এল। ঘন ঘন বিদ‍্যুৎচমক আর গাছের মাথায় লুটোপুটি খাচ্ছে ঝড়। প্রায় দৌড়চ্ছি আমি… পাড়ায় ঢুকে পড়েছি…. ঐতো ঐতো বাড়ি। বড় বড় ফোঁটা মাথায় পড়ছে….দূর থেকে শুনতে পেলাম দেবব্রত বিশ্বাসের গান। মা রেডিও চালিয়ে ঘরবার করছে… আমি ফিরছি না, ভাই খেলতে গেছে….
” সুদূর কোন নদীর পারে
গহন কোন বনের ধারে
গভীর কোন অন্ধকারে
হতেছ তুমি পার ।
আজি ঝড়ের রাতে
তোমার অভিসার
পরাণসখা বন্ধু হে আমার।”
আমি ভেজা গায়ে মাকে জড়িয়ে ধরলাম।

তবে এই স্কুলে এসে জানতে পারলাম রবীন্দ্রনাথ কত মহান একজন মনীষি! তাঁকে নিয়ে বক্তৃতা দিতেন যাঁরা, তাঁরা কত বিশ্লেষণ কত তুলনা বিশ্বসাহিত‍্যের সঙ্গে করতেন তার অনেকটা মাথার ওপর দিয়ে বেরিয়ে যেত। শুধু মন জুড়ে থাকত বন্ধু বাণীর গান “শুধু তোমার বাণী নয়গো হে বন্ধু হে প্রিয়”। আর তিনি দূরের নন… ঐ সুর বেয়ে ঢুকে পড়েছেন বুকের ভেতর। সেই যে তিনি জাগিয়ে দিলেন তাতে শরৎচন্দ্র, বঙ্কিমচন্দ্র কাউকে বুঝতেই আর কোন অসুবিধে রইল না।
জীবনের পরবর্তী পর্বে যখন অনেক বই পাচ্ছি , পড়ছি তখন অন‍্য উপলব্ধি হচ্ছে… ভাবছি শুধু কি তাঁর রচনা তাঁকে এমন হিমালয়তুল‍্য করেছে নাকি মানুষ রবীন্দ্রনাথকে কেউ অতিক্রম করতে পারছেন না। উপনিষদে তাঁর শিকড় গাঁথা আছে বলে নাকি তাঁর সমাজচেতনা বা রাজনৈতিক অবস্থান কোনখানে কোন ফাঁক নেই বলে! বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে যেন তাঁর কোন আড়াল নেই। কোথাও পড়েছি তাঁর জীবৎকালে দিলীপ কুমার রায় ইত‍্যাদি আরও বড় গায়করা রবীন্দ্রনাথের গানে তানকর্তব করার অনুমতি চেয়েছিলেন, সেইসময় তাই রীতি ছিল। তবে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন ‘ আমার গানে তো কোন ফাঁক রাখিনি ‘
আমার সামান‍্য চেতনায় মনে হয় সৃষ্টিকর্তা বোধহয় কোন ফাঁক রাখেননি রবীন্দ্রনাথে!

By Alekh

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *